রবি ঠাকুরের বাসার বাহিরে ঝুলানো ঘণ্টার দড়ি ধরে টান দিতেই টুংটাং শব্দ হল।

ভেতর থেকে একজন গৃহপরিচারিকা দরজা খুলে দিতেই রবীন্দ্রসংগীতের সুর কানে এলো।

আহ! কি সুমধুর সুর।

রবিদার ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দ আমাকে নিয়ে গেলেন কবিগুরুর কাছে।

একটি আরাম কেদারায় বসে বসে একমনে শেক্সপিয়রের রচনা পড়ছেন তিনি। বাহ আমার প্রিয় একজন লেখকের রচনা কবিগুরু পড়ছেন ভাবতেই পুলকিত হলাম।

আমাকে পাশের চেয়ারে বসতে বলে শান্তভাবে বইটা বন্ধ করে রাখলেন পাশের টেবিলে।

এখন সকলের কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ২০২০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা আতিক কিভাবে ১৯৪১ সালে রবি ঠাকুরের সাথে দেখা করলো?

হ্যাঁ, এটার উত্তর হচ্ছে টাইম মেশিনে করে গিয়েছিলাম!

পাল্টা প্রশ্ন আসতে পারে টাইম মেশিন-তো এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আমিও বলব হয়নি কিন্তু বড় বড় বিজ্ঞান গবেষকদের কাছে গোপনীয় ভাবে এটা আছে!

আমি ধার করেছিলাম ড. জাফর ইকবাল স্যারের কাছ থেকে (কিভাবে নিয়েছিলাম সেটা অন্যদিন বলব)।

দুকাপ কফি আনতে বলে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। আমি কিছুটা আড়ষ্টতায় ভুগছিলাম কারণ এরকম বিখ্যাত একজন মানুষের সামনে বসে কথা বলা চাট্টিখানি কথা নয়।

আমি উনাকে দাদা বলেই ডাকছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তিনি গুরুগম্ভীর কথাবার্তা বলবেন।

কিন্তু তিনি বেশ হাসি-খুশি কথা বলেছেন আমার সাথে। তো উনার সাথে যে ধরনের কথা হল তার কিছুটা নীচে তুলে ধরলাম:

১. জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবন সম্বন্ধে আপনার উপলব্ধি কি?

- দেখো বয়সটা হলো কিছু সংখ্যার সমষ্টি। আর জীবনটা সেই সংখ্যাগুলোর পেছনের ইতিহাস। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য চর্চা শুরু করি। তখন মানুষ আমাকে একটা উন্মাদ ভাবতো। কারণ আমি বিলেতের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম সাহিত্যের জন্য। কিন্তু নোবেল পাওয়ার পর থেকে আমি সকলের কাছে প্রচুর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলাম। এটাই হল জীবন।

২. নোবেলের কথা যেহেতু বললেনই তাহলে আপনাকে জানাতে হয় আপনার নোবেল পুরষ্কারটা ২০০৪ সালে চুরি হয়ে গেছে।

- আমি জানতাম আমার নোবেলটা শান্তিনিকেতন থেকে ২০০৪ সালের ২৫শে মার্চ চুরি হয়ে যাবে।

৩. আপনি জানতেন? তাহলে এটাকে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করলেন না কেন?

- আরে পাগল! আমাকে বোকা পেয়েছো? আমাদের ঠাকুর বাড়িতে একটি গোপন টাইম মেশিন ছিলো। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি যখন বাড়ির কর্তা হই তখন একদিন টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতে যেতে যেতে ২০০৪ সালে গিয়ে থামি। সেদিন শান্তিনিকেতন বন্ধ ছিল। আমি রাতের বেলা নিকেতনের উত্তরায়ণে যাই। এবং রাতের আঁধারে ২৮ জন চোরকে দেখি আমার স্মৃতিস্বরূপ যে জিনিসপত্রগুলো ছিল তা চুরি করছে। তখন আমি লুকিয়ে আমার নোবেলটা নিয়ে দরজা বাহির থেকে লাগিয়ে দিয়ে আসি! তারপর চোরেরা জানালার দিকের গ্রীল কেটে বের হয়ে যায়।

৪. ও আচ্ছা। কিন্তু তাহলে আমরা ২০২১ সালেও কেন সেটা খুঁজে পাচ্ছি না? আপনিকি সেটা আর শান্তিনিকেতনে ফেরত দেন নি?

কবিগুরু এবার খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথাটা নিচে নামিয়ে বললো-

- ২৫ শে মার্চকে বাংলাদেশে কালো রাত্রি বলা হয় সেটাতো জানো। আমি সেদিন শান্তিনিকেতন থেকে বের হয়ে বাংলাদেশে শাহজাদপুরে আমার কুটিরে যাচ্ছিলাম নোবেলটা আলমারিতে তুলে রাখতে। কিন্তু ঐ যে ২৫ শে মার্চ কালো রাত্রি! সেকারণে আমি অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। আর হঠাৎ করে আমার টাইম মেশিনে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। তখন টাইম মেশিন ঠিক করতে গিয়ে নোবেলটা হাত ফসকে পড়ে যায়। তারপর অন্ধকারে আর খুঁজে পাইনি।

৫. খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আচ্ছা আপনি যে ২০২১ সালেও ফেসবুকে অনেক জনপ্রিয় উক্তি দেন তাতে আপনার অনুভূতি কেমন?

- আসলে নোবেল উদ্ধার করার জন্য টাইম মেশিনে যখন ২০০৪ সালে গিয়েছিলাম তখন দেখেছিলাম জুকারবার্গ ফেসবুক বানাচ্ছে। আর ২০২১ সালেও যে ফেসবুকে আমাকে নিয়ে উক্তি দেয়া হয় সেটা জানতে পেরে আমি গর্বিত। আর হ্যাঁ কফি দিয়ে গেছে খাওয়া শুরু করো।


৬. আচ্ছা শুরু করছি। “বল দাও, মোরে বল দাও” গানটিতে বল পাবার জন্য এমন করুণ আকুতি থেকে বুঝা যায় আপনি ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু আপনার এমন আকুতি শুনে কোনো খেলোয়াড় কি আপনার কাছে বল দিতো?

- এটা সম্পূর্ণ বিরোধীদলীয় ষড়যন্ত্র। আমি এখানে ফুটবলের কথা বলিনি। তোমার টাইম মেশিনটা আমাকে ধার দিও যাতে যারা আমার নামে এসব কুৎসা রটায় তাদের দুটো গালকে ফুটবল বানিয়ে দিয়ে আসতে পারি।

৭. আপনি কবিগুরু হলেও বেশকিছু ভুল করেছেন। যেমন, নাম দিয়েছেন “শেষের কবিতা” অথচ লিখলেন উপন্যাস। আপনার মত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও নাম দিলো “পুতুল নাচের ইতিকথা” কিন্তু ভেতরে পুতুল নাচ নিয়ে কিছুই নাই। এসব কি আপনাদের বড় ধরনের ভুল মনে হয় না?

- না। কারণ আমি স্বেচ্ছায় লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি সাহিত্যের জন্য। কিন্তু তোমরাতো সাহিত্য চর্চা না করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার নেশায় আছো। তাই এমন ধোঁয়াশা পূর্ণ নামে লেখা লিখেছি। পরীক্ষায় কেমনে পাশ করো সেটা দেখে ছাড়বো!

৮. আপনার দাঁড়ি-গোঁফ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। যেমন, আপনি কিভাবে মুড়ি খেতেন?

- হা হা হা। আমি আসলে যুবক বয়সে কাদম্বিনীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলাম। কিন্তু সে যখন আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করল তখন লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া ধরেছিলাম। নতুন ছিলাম তাই লম্বা টান দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলেছি। তখন বাবার লাঠির পিটুনি থেকে বাঁচতে গোঁফ লম্বা করে ঠোঁট ঢেকে দিলাম! আর আমার বাবার গঞ্জিকা সেবনের মোটা কল্কিটার একমাথা দিয়ে মুড়ি ঢাললে অপর মাথা মুখের ভেতর দিয়ে রাখি তাতে সহজেই মুড়ি গোঁফ ভেদ করে মুখে চলে যায়! তা না হলে মৃণালীনিতো আছেই। সে গোঁফ উঁচিয়ে ধরে রাখে আর আমি মুড়ি খাই!

৯. বাহ! চমৎকার আইডিয়া। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। মনে হচ্ছে শেষ হয়েও হইলো না শেষ। শেষ প্রশ্ন, আমার আসল জন্মদিন জুলাই মাসে হলেও সার্টিফিকেটে ৭ই আগস্ট। আর আপনি নিশ্চয় টাইম মেশিনের মাধ্যমে জানেন আপনি এই ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট মারা যাবেন। তাহলে যেহেতু আপনার মৃত্যু-দিবসে আমার জন্মদিবস সেহেতু আমার উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কি?

- দেখো তোমার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলবো, যেহেতু দুজনেরেই একটা দিবসে মিল আছে তাই তোমাকেই দায়িত্ব দিচ্ছি নোবেলটা খুঁজে পেলে শান্তিনিকেতনে ফেরত দিও।

কবিগুরুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসলাম।

জমিদার হলেও একজন আন্তর্জাতিক মানের কিপ্টে মানুষ।

এত কষ্ট করে টাইম মেশিন জোগাড় করে ঘুরতে গেলাম অথচ জন্মদিন উপলক্ষে একটা উপহার দিতে পারলো না! আমি কি অনেকগুলো চাইছিলাম? এসব ভাবতে ভাবতে টাইম মেশিন থেকে বের হয়ে আসলাম।

আপনাদের কি ধারণা ছিল যে জমিদার হয়েও রবিদা এত কৃপণ হতে পারেন?


~ আতিকুর রহমান

(লেখাটি নিছক মজার ছলে লেখা। তবে চরিত্রগুলোর নাম ও ঘটনাবলী সত্য। শুধু উপস্থাপন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগলে আমি দুঃখিত)

(১৫ এপ্রিল, ২০২১)