যাতায়াতের জন্য নিয়মিতই ট্রেনে চড়তে হয়। কিন্তু সিট পাওয়া? সেতো ভাগ্যের ব্যাপার!

আমার মনে হয় ট্রেনের সিট পাওয়ার চাইতে দুরন্ত ষাঁড়ের শিং ধরে তার পিঠে উঠা অনেক সহজ কাজ!

এজন্য সবসময় ট্রেনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যাই। বাতাসও আসে আর সবুজ মাঠ-ঘাট, মানুষ দেখতে দেখতে দেখতে সময়টাও ভালো কাটে।

২ দিন আগে ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় একটা বিষয় নজরে পড়লো। ব্যাপারটা আগেও অনেক দেখেছি কিন্তু ততটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি।

রেল লাইন মেরামতকারী কয়েকজন শ্রমিক লাইনের পাশ থেকে হাত নাড়িয়ে চলন্ত ট্রেনের যাত্রীদেরকে বিদায় বা শুভেচ্ছা জানাচ্ছে বা মঙ্গল কামনা করছে অথবা অন্যের দেখাদেখি এমনিই হাত নাড়ছে।

খেয়াল করলাম শুধু তারাই নয়, চলন্ত ট্রেনের আশে-পাশে যারা থাকে অনেকেই এই কাজটি করেন। আবার আমরা যাত্রীরাও অনেকে পাল্টা হাত নাড়িয়ে জবাব দিই।

এই ব্যাপারটা এত সিরিয়াস ভাবে নেবার কিছু নেই। হয়তো নিছক মজার ছলেই আমরা এমন করি। তবে এর মধ্যে অবশ্যই নিখাদ আন্তরিকতা রয়েছে।

    Related: গ্রুপ স্টাডি: ব্যাক্তিগত ও শিক্ষা জীবনে এর প্রভাব

ব্যাপারটার একটু গভীরে যাই। আমি বা অন্যকেউ যদি ট্রেন থেকে পড়ে যাই বা ট্রেন একসিডেন্ট করে তাহলে এই শিশুদের মত হাত নাড়ানো মানুষগুলোই নিজেদের কাজ ফেলে আমাদের সেবা করবে। এতে কৃত্রিমতা থাকবে না, থাকবে পূর্ণ আন্তরিকতা। আমাদের কষ্টে তারাও কষ্ট পাবে।

তাদের সাথেতো আমাদের কোনো আত্মীয়তা বা সম্পর্ক নেই। আচ্ছা তাহলে এরকমটা কেন হয়?

একটু চিন্তুা করার পর কলেজের ক্লাসে বলা একটা ঘটনা মনে পড়লো। যতদূর মনে হয় শ্রদ্ধেয় মাহবুবুর রহমান হেনরী স্যারের (বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, মিন্টু কলেজ, ময়মনসিংহ) ক্লাস ছিল।

স্যার বলেছিলেন, তিনি যখন নেপালে (সম্ভবত) ঘুরতে গিয়েছিলেন তখন একবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। তখন একজনকে রাস্তা জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দিয়েছিল “This is your problem, not my problem"। স্যার অনেক অবাক হয়েছিলেন কথা শুনে। তারপর স্যার এরকম আচরনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমাদেরকে বলেছিলেন, “মানুষের আচরন/আন্তরিকতা বেশিরভাগ নির্ভর করে মাটির উর্বরতার উপর”।

আমরা অবাক হয়ে যখন এটার কারন জিজ্ঞেস করি, তখন স্যার বলেছিলেন, আমাদের দেশের মাটি খুবই উর্বর। তাই আমরা বেশি আন্তরিক ও অপরকে সাহায্য করতে উৎসুক। যেমন, মিন্টু কলেজের সামনে কেউ যদি আমাদেরকে “টাউন হল” যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করে তাহলে আমরা প্রয়োজনে ১ মিনিট হেঁটে গাঙ্গিনারপার মোড় থেকে তাকে অটোরিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসব। নয়তো যতটা সহজ ভাবে বুঝানো সম্ভব সেভাবেই তাকে রাস্তা বুঝিয়ে দিবো। এই ব্যাপারটারই অভাব রয়েছে নেপালে। সেখানের মাটি ততটা উর্বর নয়। সেখানে প্রচুর পরিমাণ পাহাড়ি ও পাথুরে এলাকার রয়েছে। একারনে তাদের মনে আমাদের মত আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

(স্যারের ক্লাসটি ২০১৮ সালে হয়েছিল। উনি আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেছিলেন। এই মুহুর্তে সেগুলো মনে পড়ছে না)

স্যারের বলা কথাটি আমি পরবর্তীবার উপলব্ধি করি পাওলো কোয়েলহোর বিখ্যাত উপন্যাস “দ্য আলকেমিস্ট” পড়ার সময়। সেখানে স্বপ্নচারী ছেলেটি যখন সর্দারকে “মরুদ্যান বহিঃশত্রুর আক্রমনের শিকার হতে পারে” এমন সন্দেহের কথা জানায় তখন সর্দার বলেছিল যদি তারা পরবর্তী ১ দিনের মধ্যে শত্রুর দেখা না পায় তবে ছেলেটিকে তারা হত্যা করবে। কারন অস্ত্র একবার উঠানোর পর ব্যবহার না করলে তা পরে আর কাজ করে না। মরুভূমি তাদের এটাই শিখিয়েছে।

এখানে ছেলেটি মরুদ্যানের ভালো চেয়েছিল। কিন্তু মরুর রুক্ষতা ও সংগ্রামী জীবন মরুর মানুষদের মনকে কঠোর করে তুলেছে।

এভাবে ভাবলে বুঝা যায় আমরা কত ভাগ্যবান। চারপাশের মানুষের উপর কতটা নির্ভর করতে পারি আমরা। রাস্তায় বেরুলে আমরা নিশ্চিত থাকি যে, রাস্তায় যদি আমি কোনো একসিডেন্ট করি তবুও সেখানে পড়ে থাকতে হবে না। নিশ্চিত কোনো না কোনো পাগল তার কাজ ফেলে আমাকে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে ছুটবে।


- আতিকুর রহমান