আজকেই যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয়তাহলে আজকের দিনটিকে আমার জীবনের সেরা দিন বানাতে হলে আমাকে ঠিক কী করতে হবেআমার আজকের আমলটাই যদি জীবনের শেষ আমল হয়তাহলে আমার আজকের দিনের আমলগুলো ঠিক কেমন হতে হবেবেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আসন্ন হচ্ছে আল্লাহর প্রতিশ্রুত সময়।” (বেলা ফুরাবার আগে)

বেলা-ফুরবার-আগে


টিক টিক শব্দে এগিয়ে চলেছে দাদার ঘরের দক্ষিণের দেয়ালে টানানো ঘড়ির কাঁটাটি। পেন্ডুলামটি দোলছে অনবরত।

দাদাভাইকে নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম ঐদিকে। দিনের বেশীরভাগ সময় বই পড়ে আর ঘড়ির দিকে এমন করে তাকিয়েই কাটে উনার।

দাদীমা ছাড়া কাউকে কিছু বলেন না সহসায়। নির্বাক, শান্ত পরিবেশ সর্বদা বিরাজ করে উনার ঘরে।

কোনোদিন আমাদের কাউকে তার এই রহস্যময় নীরবতার কারণ বলেননি। আমি আজন্ম দেখে আসছি তার অন্তহীন নীরবতা।

আজ উনার পাশে বসলাম।দীর্ঘদিনের অজানা প্রশ্নটি হঠাৎ জিজ্ঞেস করেই ফেললাম:

- দাদাভাই, আপনারে সেই ছোটবেলা থেকে দেখতেছি চুপচাপ থাকেন। আমাদের সাথেও কথা বলেন না ঠিকমত। আমি কি জানতে পারি আপনার কিসের এত কষ্ট বা অভিমান?

- হ্যাঁরে জানতে পারিস। আর কতদিনই বা বাঁচবো তাই তোকেই নাহয় বলি। যদি কিছু শিখতে পারিস।

- বলেন দাদাভাই।

প্রশান্ত গলায় দাদাভাই বলতে আরম্ভ করলেন,

- আমি গড় আয়ু অতিক্রম করলাম অনেকদিন আগে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছেন তাই আলহামদুলিল্লাহ। আমার বন্ধুরা অনেক আগেই গত হয়েছে।  জীবনে আমি প্রায় সব পেয়েছি টাকা, যশ, খ্যাতি, সম্মান, দুঃখ, কষ্ট প্রায় সবকিছু। কিন্তু একটা জিনিস এখনো পেয়েছি কিনা জানি না।

- এটা এমন কি জিনিস যে আপনি নিজেই জানেন না পেয়েছেন কিনা?

- আমার সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ক্ষমা।

- কেন দাদা? আমিতো দেখছি আপনি নিয়মিত নামায পড়েন, কোরআন পাঠ করেন। এলাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা সব করেছেন। তাছাড়া এখনো উদার হাতে দান করেন। তাহলে কি এমন অপরাধ করেছেন যে, আজো এত প্রায়শ্চিত্ত করছেন? নিজে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবেন এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

- আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে ছিলাম। তাই পরিবারের শাসন-হীনতায় একটা অমানুষে পরিণত হয়েছিলাম। অনেক অন্যায় অপরাধ করেছি জীবনে। তবে সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছি আমার একমাত্র ছেলে আকবরের প্রতি আদর্শ পিতার দায়িত্ব পালন না করে একটা সন্ত্রাসী বানিয়ে।

- কিন্তু দাদুভাই আমার বাবাতো তানভীর আহমেদ। তাহলে আকবর সাহেব কে?

-  আকবর আমার একমাত্র ছেলে ছিল। আচ্ছা তুই কি জানিস পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী জিনিস কি?

- অবশ্যই জানি। হিমালয় পাহাড়ের চাইতে আর কি ভারী জিনিস থাকতে পারে?

- নারে তুই জানিস না। সেটা হল পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ।

দাদাভাইয়ের দুই গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। নীরব কান্নায় মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছে কণ্ঠ। তবু বলতে থাকলেন,

- আকবর যেদিন পাশের এলাকায় একটা জমি দখল করতে গিয়ে মারামারিতে মারা যায় সেদিন তার লাশ কাঁধে নিয়ে আমার হুঁশ ফেরে। আমি এতদিন কি করলাম? কাদের জন্য করলাম? সেদিনের পর থেকে বিমর্ষ অবস্থায় কাটতে লাগল আমার দিন।


ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

- তারপর?

- আমার এমন হতাশা ও বিষণ্ণতা দেখে তোর দাদীমা জোড় করে একজন আলেমের কাছে পাঠায়। তারপর তিনি আমার সব শুনে আল্লাহ তায়ালার কাছে তওবা করে দ্বীনের পথে আসার আহ্বান জানান। আমি এরপর আল্লাহ প্রদত্ত পবিত্র গ্রন্থ সহ সহায়ক অনেক বই পড়া শুরু করি।আমার বিষণ্ণতাও কেটে যেতে শুরু করে। আমি অনুতপ্ত হই। সম্পদের বেশিরভাগই আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিয়েছি।

- আল্লাহ আপনার তওবা কবুল করুক দাদুভাই। কিন্তু আমার বাবা আপনার কে হয়?

- তোর বাবাও আমার ছেলেইরে দাদুভাই। আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসার পর আল্লাহই তোর বাবাকে আমার সন্তান রূপে পাঠান। আমার এতিমখানা থেকে তোর বাবাকে ছেলে হিসেবে নিয়ে আসে তোর দাদীমা। সে আমদের নিজের সন্তানের চেয়েও বেশী আপনজন। কিন্তু.....

- কিন্তু কী দাদুভাই?

- কিন্তু আমার আকবরকে আমি মানুষ বানিয়ে সৃষ্টিকর্তার পাশে পাঠাতে পারিনি। আমি এর জন্য পুরোপুরি দায়ী। সে এতকম বয়সে চলে যাবে কখনো ভাবিনি। সে তো যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। জানি না সে এখন কিরকম শাস্তি ভোগ করছে।জাহান্নামের যে ভয়াবহ শাস্তি তা কি সে সহ্য করতে পারবে? এই অনন্ত জীবনে তার কি কোনোদিন ক্ষমা হবে? আফসোস সে যদি একটু বুঝতো......

দাদীমার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে বাস্তবে ফিরে এলাম। তিনি কতক্ষণ ধরে আমাদের কথোপকথন শুনছেন খেয়াল করিনি। তিন জনের চোখেই কান্নার অঝোর ধারা। শেষে দাদাভাইয়ের কান্না মিশ্রিত গলায় শুধু এটুকুই শুনতে পেলাম:

- আমাদের এত দোয়া, আহাজারি শুনেও আল্লাহ আকবরকে ক্ষমা করবেন নারে দাদুভাই?


৪ দিন পর...

আজ আসরের নামাযের পর দাদাভাইয়ের ঘরে ঢুকে নিরন্তর দোলায়মান পেন্ডুলামটির দিকে তাকালাম। ঘরে সবই আগের মত আছে। শুধু দাদাভাই নেই।

আজ বাদ জুম্মা জানাযার নামায পড়ে পৃথিবীর অন্যতম স্থায়ী ঘরে শুইয়ে দিয়ে এলাম।জানি না এখন কি অবস্থায় আছেন।

পশ্চিম আকাশের হেলে পড়া সূর্যের ম্লান আলোয় ঘড়ির ঘূর্ণায়মান কাঁটার টিক টিক শব্দের সাথে মিলিয়ে আমার কানে বেজে যাচ্ছে উনার গতকাল বলা শেষ কথাটি, “দিনগুলি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখনই প্রস্তুতি নে ওপারে যাওয়ার। আমার আকবরের মত ভুল কেউ করিস না।”


-আতিকুর রহমান